৫ই নভেম্বর, ২০২২, ইং
কোলকাতার উপকন্ঠে সোদপুর শহর। নভেম্বরের প্রথম শনিবার এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হল। আমার ৯ বছরের কন্যার দৌলতে বিরল এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। কথা ও সম্বর্ধনা দিয়ে শুরু হয়ে এই অনুষ্ঠান এক মূহুর্তের জন্যেও নিজের উপস্থিতি লঘু হতে দেয়নি।
খালি গলায়, বৃষ্টি ভট্টাচার্যোর দৃপ্ত কণ্ঠে গান দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। সবাই নিজ নিজ স্থান নিয়ে স্থিতু হয়ে বসতে বসতেই যা কিনা আগামী অনুষ্ঠানের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে দিল। শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান, সমবেত উচ্চারণে কবিতা কোলাজ ও কবিতাশ্রয়ী উপস্থাপনা। বিশিষ্ট কবি ও আবৃত্তিকারদের সামনে থেকে উপস্থাপনা করতে দেখা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কবিতাগুলো কখনো বা প্রেমের মালভূমিতে ওঠানামা করে, কখনো আবার খোঁচাওয়ালা কোনওয়ালা গথিক গির্জার ছাঁদ যেন বুকে চেপে বসিয়ে দেয়। সাদেকুল সাহেবের গলার ওঠানামা আজীবন থাকবে মনে। অনুষ্ঠানের শেষ উপস্থাপনার ঠিক আগের উপস্থাপনাতেও বাচিক শিল্পী শ্রীমতী স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সতন্ত্র ভাব অপূর্ব ভাবে তার গলা বেয়ে শ্রোতাদের মনে গেঁথে গেলো। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম কবি শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে তার লেখা কবিতা। কবিতাটি লগান চলচিত্রের একটি গানের কিছু কথায় ভর করে লেখা সময় উপযোগী এক কবিতা। দু কান ভরে শুনতে শুনতে এই কণ্ঠগুলো কখন যে মনের মধ্যে একটা কোটর নিয়ে বাসা বাঁধছে তা বুঝতেই পারিনি। যাইহোক, আর একজনের কথা বলতেই হবে, তিনি বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের শোনালেন একটি মাত্র বাক্যে লেখা কিছু কবিতা। রামপুরহাট থেকে আসা কবির গলায় প্রথম একথা শুনে ভাবছি, সেকি! এরকম আবার কবিতা হয় নাকি! কিন্তু দারুণ লাগলো। শুনতে শুনতে মনে হলো, এইতো শুনছি যুগ উপযোগী কবিতা। আজ থেকে অনেক বছর পর এই সময়টাকে যখন কেউ বুঝতে বা ধরতে চাইবেন, তার কাছে এই সময়ের বেদনাদায়ক, বিভেদ সৃষ্টি করা ও বিভেদ মোছার লেখা যেমন থাকবে তার জন্য তেমনি থাকবে এই এক বাক্যে লেখা কবিতাগুলিও। যা কিনা শুধু এই সময়ের, সময়ের দৈন্যতাই বোঝাবেনা, সে সাক্ষ্য বহন করবে এ সময়ের গতিকেও। একটি মাত্র বাক্যই যে আজ বেশি হয়ে যায়! কি করবে সময় নেই যে! কবিকে তাই কুর্ণিশ জানাতেই হয়। মনের এই কুঠুরিতে আপনাকে স্বাগতম।
এতো গেল একক পাঠ, আমন্ত্রিত শিল্পীদের দ্বারা। এবার আসি কোলকাতা কল্পকের সদস্যদের দ্বারা পরিবেশন করা কবিতা কোলাজের কথায়। ধানশিড়ি আমার কন্যা, ও তার বন্ধুরা, মুগ্ধা, আয়ুস আর দেবপ্রিয়া, ওরা গল্পের ছলে পরিবশন করলো এক আজব দেশের কথা। ছিল অন্যান্য কবিতার সাথে আমার অত্যন্ত প্রিয় সুকুমার রায়ের কিছু কবিতার তোড়া। শেষে যখন তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম উচ্চারণ হচ্ছে, মনের ভেতর যেন এক বেদনা মেশানো মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো। কবির শেষ ছড়া এটি! সুকুমার রায় যেন আবার আমার মধ্যে বেঁচে উঠলেন। বাচ্চাগুলো অনবদ্য আবৃত্তি করলো। ওদের উচ্ছাস যেন ছড়িয়ে পড়লো মঞ্চ থেকে দর্শকবৃন্দের মধ্যে। সেই রেশ ধরে রেখেই প্রেম থেকে বিবাহ থেকে সম্পর্ক থেকে বর্তমান সময়। এই সব নিয়ে একের পর এক কবিতার ধারা বয়ে চললো অডিটোরিয়াম জুড়ে। শেষে এই কর্মকাণ্ডের কর্ণধার 'গার্গী সেনগুপ্ত' এলেন তার উপস্থাপন নিয়ে, 'এই দেশ এই সময় ' নামে একটি কবিতা কোলাজ। ওনার সাথে কোরাস হিসেবে কল্পকের কিছু সদস্যরাও ছিলেন। মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনেগেলাম, ধরে রাখার চেষ্টা করেগেলাম সময় উপোযোগী তার উপস্থাপনাটা। খোঁচা নয়, এ রেখে যায় এক গভীর প্রশ্ন, কোথায় রেখে যাচ্ছি আমাদের উত্তরসুরিদের!
হল থেকে বেরিয়ে এলাম তবু এই সন্ধ্যা থেকে গেল মনে। মুগ্ধতার ফাঁকে ফাঁকে কিছু ছবি তুলছিলাম। মুহূর্তগুলোকে চেষ্টা করেছি প্রযুক্তিতে ধরে রাখার। মূহুর্তরা শুধু উপস্থিত থাকার প্রমাণ নয়, তারা যেন হয়ে থাকে অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে এই আশা করি!
- আর্য্য
Comments